দেশেই উৎপাদন হচ্ছে বিদেশী ফল স্ট্রবেরি ও ড্রাগন
কৃষিবিদ শারমিনা শামিম
স্ট্রবেরি চাষ করে প্রথম বছরেই তাক লাগিয়ে দেয় চুয়াডাঙ্গার রুহুল আমীন রিটন। চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার পেয়ারাতলা গ্রামে একটি দরিদ্র পরিবারে জন্ম হয় রিটনের। তাই পরিবারের অর্থনৈতিক কষ্ট দূর করতে অতি অল্প বয়সে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। ২০০২ সালে এসএসসি পাস করার পরেই তিনি ধান কিনে চাল তৈরি করে বাজারে বিক্রি করতেন। এভাবে কেটে যায় বেশ কয়েকটি বছর। স্বল্প পরিসরে ব্যবসা চলতে থাকে। কিন্তু রিটন সব সময়ই স্বপ্ন দেখতেন বড় কিছু করার, দেশের জন্য কিছু করার। তিনি নিজেকে একজন বড় উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলেন। এ ভাবনা প্রতিনিয়ত তাকে নতুন কিছু করার তাগিদ দেয়। ২০১৬ সালে ব্যবসার সামান্য পুঁজি ব্যবহার করে তিনি চাষাবাদ শুরু করেন। প্রথমে তিনি জীবননগর উপজেলার খয়েরহুদা মাঠে বত্রিশ বিঘা জমি লিজ নিয়ে কলম্ব লেবু ও বারোমাসি (ঙউঈ ৩) জাতের সজিনার চাষ শুরু করেন। কিন্তু মৌসুমের মাঝামঝি যখন ফল ধরতে থাকে, তখন তিনি লক্ষ্য করেন এ ফসলগুলো বাজারজাতকরণে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য। ফসল বিক্রি করে লাভ তো দূরের কথা, মূলধন তুলে আনাই কঠিন হয়ে পড়ে। ক্ষতি হয় প্রায় সাতাশ লক্ষ টাকা। কিন্তু হাল ছাড়লেন না পেয়রাতলা গ্রামের শিক্ষিত স্বনির্ভর যুবক রুহুল আমিন।
যখন তিনি বুঝলেন কলম্বো লেবু ও সজিনা চাষে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না, তখন তিনি একই জমিতে আন্তঃফসল হিসেবে থাই পেয়ারা ৩ লাগালেন। ২০১৮ সালে থাই পেয়রা গাছ থেকে ফলন পেতে শুরু করেন। প্রথম বছর থাই পেয়ারা বিক্রি করে লাভ করেন প্রায় ৪৫ লক্ষ টাকা। বর্তমানে ৪ হেক্টর জমিতে পেয়ারা বাগান রয়েছে। এই পেয়ারা বাগান থেকে প্রতি বছর বিঘা প্রতি প্রায় ২৭০ মণ পেয়ারার ফলন পান। পরবর্তী বছরগুলোতে লাভের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে তিনি ৭০ লক্ষ টাকা লাভ করেন শুধু পেয়ারা বাগান থেকেই।
এখানেই শেষ নয়, শুরু হয় নতুন পথের যাত্রা। ২০১৮ সালে মাত্র ৪ বিঘা জমিতে বারি ড্রাগন ১ জাতটির চাষাবাদ শুরু করেন। ২০১৯ সালে এখান থেকে লাভ করেন প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা। বর্তমানে ৬৫ বিঘা জমিতে ড্রাগন ফলের চাষ করছেন। এখানে ১ লক্ষ ৭০ হাজার গাছ রয়েছে। ড্রাগন ফল একটি লাভজনক ফসল। এ ফসল চাষে প্রথম বছর একটু খরচ বেশি হলেও পরবর্তী বছরগুলোতে তেমন খরচ হয় না। রিটনের ড্রাগন বাগানে হেক্টর প্রতি ফলন হয় ২৯.৫০ টন। ড্রাগন ফল চাষে তিনি মোট বিনিয়োগ করেন ৫৮ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা। প্রতি বছর গড়ে উৎপাদন খরচ হয় ১১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা এবং লাভ হয় প্রায় সাড়ে চল্লিশ লক্ষ টাকা। ড্রাগনের পাশাপাশি তিনি স্ট্রবেরি, পেয়ারা, আনার, আঙ্গুরসহ বেশকিছু ফলের চাষ শুরু করেছেন।
তিনি এক খ- জমিতে কমপক্ষে দুই ধরনের ফল গাছ লাগিয়েছেন। ফলে প্রায় সারাবছরই জমি থেকে আয় হচ্ছে। ড্রাগন বাগানে ফল ধরে সাধারণত মে থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত। বাকি সময় কৃষক রিটন নভেম্বর মাসে ড্রাগন বাগানের শেডের পাশেই নতুন শেড তৈরি করেন। আর সেই শেডের পাশেই স্ট্রবেরির চারা সংগ্রহ করে ড্রাগন ফলের সাথে সাথী ফসল হিসেবে চল্লিশ বিঘা জমিতে লাগান আমেরিকান ফেস্টিভ্যাল জাতের স্ট্রবেরি। এখানে ৯৫ হাজার গাছ রয়েছে। এর মধ্যে ছত্রাক লেগে প্রায় ৩০ হাজার চারা মারা গেছে। স্ট্রবেরী চাষে তিনি সম্পূর্ণ জৈবসার ব্যবহার করেছেন। কচুরিপানা থেকে উৎপাদিত কম্পোস্ট সার ব্যবহার করে মাদা তৈরি করেন। চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত কেরু অ্যান্ড কোং এ চিনি উৎপাদনের পর উপজাত দ্রব্য থেকে তৈরি জৈবসার প্রতি মাদার চারিদিকে রিং পদ্ধতিতে প্রয়োগ করেন। তিনি সেচের পানিতে ১:১০০ অনুপাতে সরিষার খৈল প্রয়োগ করে সুফল পেয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে সরিষার খৈল ও পানি ১:১০ অনুপাতেও প্রয়োগ করে থাকেন। ভাতের মাড়, আখের গুঁড়, গরুর মূত্র ও খেসারি ডালের বেসন এ উপাদানগুলো পানিতে মিশিয়ে একপ্রকার জৈবসার তৈরি করে তিনি নিজেই পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করেন। চারা রোপণের ৭০-৮০ দিনের মধ্যে ফল বিক্রির উপযুক্ত হয়। সে ফল দেশের বিভিন্ন জেলায় পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে। বড় শহরে চাহিদার তুলনায় দামও বেশ ভালো পাওয়া যাচ্ছে। প্রথম বারেই বড় অংকের লাভের আশা করছেন কৃষক রুহুল আমিন। স্ট্রবেরি ১,০০০-১,২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। বাগানে বর্তমানে ৬৫ হাজার স্ট্রবেরি গাছ রয়েছে। প্রতিটি গাছ থেকে ৭০০-৯০০ গ্রাম পর্যন্ত ফল পাওয় যায়। স্ট্রবেরি বিক্রি করে তিনি প্রথম বছরেই স্থানীয় কৃষকসহ অনেকেরই নজর কাড়েন। শুধু তাই নয় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকেই দেখতে আসেন রুহুল আমিন রিটনের খামার। যেহেতু প্রথমবারের মতো এ জাতের স্ট্রবেরি আবাদ করা হয়েছে সেহেতু কিছুটা আশঙ্কা ছিল। কিন্তু স্ট্রবেরি উৎপাদনে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায় এবারেই। স্থানীয় বাজারে তেমন একটা পরিচিতি না থাকলেও ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহরে এর চাহিদা অনেক। তাই বাজার দর বেশ ভালো।
রিটনের স্ট্রবেরি বাগানে প্রায় প্রতিদিনই ৫০-৬০ জন দিনমজুর কাজ করে। এদেরকে দুপুরের খাবার দেওয়া হয়। এখানে কাজ করে অনেকেরই জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে। রিটনের বাগানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করলে ৫০০ টাকা করে মজুরি দেওয়া হয়। এক বেলা কাজ করলে দেওয়া হয় ৩০০ টাকা। স্ট্রবেরি চাষে তিনি বিনিয়োগ করেন ২৬ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা। এ পর্যন্ত তিনি ৩৩ লক্ষ ৯ হাজার টাকার স্ট্রবেরী বিক্রি করেছেন। এখানে উল্লেখ্য, এ বছরের জানুয়ারি মাস থেকে স্ট্রবেরি উত্তোলন ও বিক্রি শুরু করেন।
রিটন তার এ খামারের নাম দিয়েছেন গ্রীন প্লানেট এগ্রো। এ যেন সত্যিই চোখ জুড়ানো এক খ- সবুজ।
রিটনের উৎপাদিত ফসলের পরবর্তী ব্যবস্থাপনার কথা চিন্তা করে যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের পক্ষ থেকে উপজেলা কৃষি অফিসের সহায়তায় একটি পলিসেড স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই সেডে তিনি উৎপাদিত ফসল বাছাই, পরিষ্কারকরণসহ বাজারজাত এর জন্য প্রস্তুত করতে পারবেন।
রবি মৌসুমে ৪০ বিঘা জমিতে ব্রিধান ২৮, ব্রিধান ২৯, ব্রিধান ৪৯ ও ব্রিধান ৫১ বোরো ধানের চাষ করেন। এছাড়া তিনি ১০ কাঠা জমিতে বারি সূর্যমুখী-৩, সূর্যমুখী ৮ বিঘা জমিতে ভুট্টা-৭৫৫ ও ২ বিঘা জমিতে চাঁপাকলা ও নেপালি কলা চাষ করেছেন। আরো রয়েছে সাগর কলা, বল সুন্দরী কুল, থাই আমলকী। পরীক্ষামূলকভাবে ওয়ান্ডারফুল, মোলর, ডলসি, হিকাজ, পারসিয়াংকা, সফটসিড-১, সফটসিড-২, সফটসিড-৪, ভাগোয়া, সুপার ভাগোয়া, গণেশসহ প্রায় ষোলটি জাতের আনার গাছ, রেডগ্লোভ, ব্লাক ম্যাজিক, ওয়ান্ডারফুল, সোনাকা, সুপার সোনাকা, ইসাবিলা, নিরো, কার্ডিনাল, ক্রিমসন, বিডিগো, থমসন, নানা শাহেদ পার্পল, মামা জাম্বো, শরৎসিডলেস, ফ্লেমসহ আরো দশ প্রজাতির আঙ্গুর গাছ লাগিয়েছেন।
রুহুল আমিন রিটনের এ বাগান দেখতে আসেন দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই। অনেকে আসেন বাগানের নৈস্বর্গীক পরিবেশে কিছুটা সময় পার করতে। অনেকে আবার পরামর্শ নেন কিভাবে গড়ে তোলা যায় এ রকম একটি বাগান। বেকার ও কর্মসংস্থানহীন যুবক সমাজের জন্য রিটন একটি দৃষ্টান্ত।
লেখক : আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খুলনা। মোবাইল : ০১৭১৬৭৬৮৮২১, ই-মেইল : aiskhulna1@gmail.com